তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মকবুল হোসেনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ঘটনায় প্রশাসনজুড়ে তোলপাড় অবস্থা বিরাজ করছে। কী এমন ঘটনা ঘটল যে, তাকে হঠাৎ করে একেবারে চাকরি থেকে সরিয়ে দিতে হলো। উত্তরটা খুবই সহজ। কিন্তু বলা খুব কঠিন। কারণ যারা জানেন তারা কিছুই বলবেন না। তবে যেসব নীতিনির্ধারক এমন সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে নিয়েছেন তাদের কাছে নিশ্চয় সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কেউ অফিসিয়াল বক্তব্য না দিলে সবাইকে গুজব আর নানারকম কৌতূহলের ওপরই ভর করতে হবে। হচ্ছেও তাই। যে যার মতো প্রশ্ন আর উত্তর মিলিয়ে নিচ্ছেন। গুজবের ডালপালা ছড়াচ্ছে দ্রুতগতিতে। তবে এই বাধ্যতামূলক অবসরকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত সরকারি দল সমর্থক বেশ কয়েকজন প্রভাবশলী কর্মকর্তা বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছেন। তারা তাদের চরম ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
তাদের মতে, প্রথমত, সচিব পদে এমন কাউকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না, যাকে ভবিষ্যতে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে বাড়ি পাঠাতে হবে। সঙ্গতকারণে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলবে- তাহলে এমন সচিব বানালেন কেন? অতএব নিয়োগ দেওয়ার সময়ই সব দিক বিচার-বিশ্লেষণ করে সমগ্র চাকরিজীবন সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া উচিত। যদি চাকরিজীবনে কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্কারি কিংবা গুরুতর কোনো অভিযোগ ওঠে, তাহলে তাকে আর যাই কিছু হোক না কেন, সচিব করা ঠিক হবে না। এছাড়া যে সভায় যাদের চিন্তাভাবনা থেকে সচিব করা হয়, সেই কমিটি বা সিস্টেমকে পরিবর্তন করতেই হবে। বরং তারা মনে করেন, সচিব পদোন্নতি দেওয়ার কমিটিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীসহ আরও ২-১ জন সিনিয়র মন্ত্রীকে যুক্ত করা উচিত। কেননা দীর্ঘদিন থেকে যেসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সচিব করা হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে বিশেষত কয়েকটি দিক অনুসরণ করা হয়। সবার আগে অলিখিত একটি নিয়ম হলো কে কার লোক। এই অভিযোগ কিন্তু খাতা-কলমে কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। কিন্তু এটিই চিরসত্য। শুধু বর্তমান সরকারের সময়ে নয়, বিএনপি আমলেও এই অলিখিত প্র্যাকটিস মহামারিতে রূপ নিয়েছিল। যে কারণে খুবই গুণধর দুজন প্রভাবশালী সিএসপির মধ্যে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ ছিল। সম্পর্ক এতটাই খারাপ ছিল যে, কেউ কারও ছায়া মাড়াতে চাইতেন না। যাহোক সচিব নিয়োগের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিবেচনায় থাকে সুপারিশের তালিকা। কোন প্রভাবশালী কার কার জন্য সুপারিশ করেছেন ইত্যাদি। অবশেষে হয় কিছু পেশাদার ও মেধাবী কর্মকর্তার নামের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা। যা শেষ পর্যন্ত অনেক সময় ধোপে টেকে না। যদি নিয়োগ দেওয়ার মতো অবশিষ্ট কোনো পদ খালি থাকে তা হলে তারা সচিব হতে পারেন।
তারা বলেন, এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা তিনি ওই সভায় সদস্য থাকার সময় তার মন্ত্রণালয় থেকে ১০ম ব্যাচের ৪-৫ জনকে সচিব করেন। শুধু তার সুপারিশেই সচিব করা হয়েছিল। যিনি এখন অবসরে গিয়ে অনেক বড় পদে বসার জায়গা পেয়েছেন। অথচ তখন তাদের থেকে ওই ব্যাচের অনেক দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তা ফিট ছিলেন। অতএব ‘মুখ চিনে খাতির’ করার অলিখিত এই পদ্ধতি বাদ দিতে হবে। এছাড়া দেখা যাবে, বিশেষ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত থেকে বড় স্যারদের নেক নজরে আসতে পারলেই কেল্লাফতে। অটোমেটিক তাদের নাম সচিব পদের জন্য প্রস্তাব করা হয়। বিভাগীয় কমিশনার পদে টিকিট পাওয়া একেবারে মামুলি বিষয়। আর এখন বিভাগীয় কমিশনার পদে পোস্টিং পাওয়া মানে ধরে নেওয়া হয় তিনি সচিব হচ্ছেন। এর ফলে গত ১৫ বছরে যারা সচিব হয়েছেন তাদের বেশিরভাগ সরকারবিরোধী কর্মকর্তা। কিন্তু বাস্তবে আবার তাদের হাবভাব হম্বিতম্বি এমন থাকে যে, যেন প্রসাশনে তারাই বড় আওয়ামী লীগার। তাদের সঙ্গে প্রকৃত আওয়ামী লীগার কোনোদিন দলবাজির প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবেন না। তার মানে এই নয় যে, আমরা প্রশাসনে একেবারে আওয়ামী প্রশাসন বানানোর লাইসেন্স দিতে বলছি। অবশ্যই প্রশাসন নিরপেক্ষ ও পেশাদার হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, কেউ যেন শয়তানের কাছে নিজের আত্মা বিক্রি করে দিয়ে সুবিধাবাদী না হয়ে যায়। ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী যদি নিরপেক্ষভাবে তাদের সমগ্র চাকরিজীবন সম্পর্কে গোয়েন্দা রিপোর্ট সংগ্রহ করেন, তাহলে এর প্রমাণ পাবেন। গত ১৫ বছরে কারা সচিব হয়েছে এবং কারা তাদের সচিব করার জন্য সুপারিশ করেছেন সব জানা যাবে। আমরা মনে করি, এটা নিয়ে একটা সত্যিকার অ্যানালাইসিস করার এখনই সময়।